আমেরিকা প্রতিনিধিঃ যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে গত ৯ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, থেকে বিচারের শুনানি শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি পর পর দুইবার অভিশংসিত এবং দায়িত্ব ছাড়ার পর তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যাকে অভিশংসনের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হলো।
> গত ৯ ফেব্রুয়ারি সিনেটে ট্রাম্পের আইনজীবীরা বিচারের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। ট্রাম্পের আইনজীবী ডেভিড স্কোইন যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় অভিযোগ করেছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে আটকাতে ডেমোক্র্যাটরা অশুভ উদ্যোগ নিয়েছে। আইনজীবীদের দাবি, এই বিচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী সাবেক প্রেসিডেন্টের মত প্রকাশের স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে এই বিচার মার্কিন সংবিধানের বিরোধী বলে যুক্তি দিচ্ছেন ট্রাম্পের আইনজীবীরা।
তবে, সিনেটের অভিশংসন শুনানিতে আইনজীবীদের ‘অদক্ষতা’য় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, তার আইনজীবীরা সিনেটে অগোছালো বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, মঙ্গলবারই (৯ ফেব্রুয়ারি) এটি সিনেটে শেষ হতে পারতো। উল্লেখ্য, বিচার শুনানি অব্যাহত রাখার পক্ষে সিনেটে ভোটাভুটি হয়েছে। ৬ জন রিপাবলিকান বিচারের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
এদিকে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার বিষয়ে সিনেট নেতারা একমত হয়েছেন। তবে এ বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার কৌশল নিয়েছেন ট্রাম্পের আইনজীবীরা। তারা একে ‘বেআইনি ও রাজনৈতিক নাটক’ বলে অভিহিত করেছেন। অভিশংসন বিচারের পাশাপাশি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে জর্জিয়ায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত শুরু হয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলায় সমর্থকদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ অভিযোগে ট্রাম্পকে ইতোমধ্যে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসন করা হয়। অভিশংসনের সময় সদস্যরা নিশ্চিত করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে উসকানি দিয়ে ক্যাপিটলে তাণ্ডবের ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ‘ইনসাইটিং ইনসারেকশন’ বা দেশদ্রোহে উসকানির অভিযোগে তাকে অভিশংসন করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, বিচার শুরুর আগে বিচার কর্তৃপক্ষের (সিনেট) কাছে বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তির সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছেন। দুদিনের শুনানিতে উভয় পক্ষকে ১৬ ঘণ্টা করে সময় দেওয়া হবে। বিচার প্রক্রিয়া পরের সপ্তাহেও গড়াতে পারে।
> ট্রাম্পের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে দেওয়া ৭৫ পৃষ্ঠার যুক্তিতে বলা হয়েছে, দেশের সমস্যা সমাধানের দিকে নজর না দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্টকে নিয়ে রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। সাবেক একজন প্রেসিডেন্টকে এভাবে সহিংসতার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা উদ্ভট। এ বিচারকে তারা বেআইনি ও রাজনৈতিক নাটক বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের আইনজীবী দলের প্রধান যুক্তি হলো- গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার জন্য ট্রাম্প কোনো উসকানি দেননি। তার সমর্থকরা স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তাকে অভিশংসন করা অসাংবিধানিক। আইন গবেষক প্রফেসর ব্রায়ান কাল্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এ দাবি করা হয়। তবে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির আইনের প্রফেসর ব্রায়ান কাল্ট বলেছেন, তার গবেষণা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিচারপূর্ব এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, অভিশংসন বিচার অসাংবিধানিক। কারণ ট্রাম্প দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এবং এখন তিনি একজন সাধারণ নাগরিক।
অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাট দলীয় আইনজীবীরা বলেছেন, ট্রাম্প তার সমর্থকদের কংগ্রেসে হামলার উসকানি দিয়েছেন। ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি ২৩২ বছরের মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে সাংবিধানিক অপরাধ। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা চাক শুমার জানান, ট্রাম্পের অভিশংসন বিচার সৎ, স্বচ্ছ ও পদ্ধতিগত করতে সব পক্ষ একমত হয়েছে। দ্রুত বিচার শেষ করতে একটি সময়সীমা নিয়েও তারা একমত হয়েছেন।
এদিকে জর্জিয়া রাজ্যে নির্বাচনের ফল পালটে দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়ার অভিযোগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজ্যটির সেক্রেটারি অব স্টেট তদন্ত শুরু করেছেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে রাজ্য ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করতে পারবে। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে ভোটে জালিয়াতি হয়েছে অভিযোগ করে ট্রাম্প ফল পালটে দিতে গত ২ জানুয়ারি টেলিফোনে রাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রাড রাফেনস্পারজারকে চাপ দেন। এ ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায়। এখন এর তদন্ত করছে সেক্রেটারি অব স্টেট অফিস। এ তদন্তকে ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ও প্রশাসনিক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন শুনানি শুরু হলেও তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম, তা এক রকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তবে অভিযোগ থেকে বাঁচলেও আইনের মারপ্যাঁচ থেকে বের হওয়া তাঁর জন্য সহজ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিশ্লেষকদের মতে, শিগগিরই ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন ট্রাম্প।
যদিও ট্রাম্পের জন্য মামলা নতুন কোনো বিষয় না। তাঁর বিরুদ্ধে আগে থেকেই বেশ কয়েকটি দেওয়ানি অভিযোগ ছিল, যেগুলো থেকে তাঁকে রক্ষা করতে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর আইনজীবীরা লড়াই চালিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর সাধারণ নাগরিকে পরিণত হয়েছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এত দিন যে দায়মুক্তি ভোগ করার সুযোগ ছিল, তা তাঁর আর নেই। ফলে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়েছে তাঁর। বিশেষ করে ম্যানহাটানের আইন প্রণেতা সাইরাস ভান্স পরিচালিত আয়কর ফাঁকির অভিযোগে ফাঁসার জোরালো আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ট্রাম্পের। ভান্স দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
প্রথম দিকে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দুই নারীকে দেওয়া অর্থ দেওয়া নিয়ে অভিযোগটির কাজ শুরু হলেও বর্তমানে এতে আয়কর ফাঁকি, বীমা ও ব্যাংক জালিয়াতির অভিযোগও যুক্ত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের হিসাবরক্ষকদের এ সংক্রান্ত নথিপত্র ভান্সের দলের কাছে সরবরাহের আদেশও দিয়েছিলেন। মামলাটি এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। তবে ভান্সের লোকজন এর তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মার্কিন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। ভান্স দল সম্প্রতি ট্রাম্পের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত একটি ব্যাংকের কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা ট্রাম্পের বীমাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এবং তাঁর সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছে।
এ ছাড়া নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমসও অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত করছেন। তাঁর তদন্ত দেওয়ানি হলেও সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তদন্ত করতে গিয়ে কোনো ফৌজদারি অপরাধের খোঁজ পেলে মামলার ধরন পাল্টে যেতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে বিপদেই পড়তে হবে ট্রাম্পকে। একে তো এ ধরনের অভিযোগে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার থাকে না তাঁকে ক্ষমা করার, তার ওপর নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগেই বলে দিয়েছেন যে তিনি কোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন না। ফলে ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত জেলে যেতেও হতে পারে।
তবে ব্যাপারটি এত সহজ নাও হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনায় ট্রাম্পকে জেলে পাঠানোর আগে আইন প্রণেতারা দ্বিতীয়বার ভাববেন বলেই মতো দিয়েছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তিনটি দেওয়ানি কার্যক্রম পরিচালনাকারী আইনজীবী রবের্টা ক্যাপলেন বলেন, ‘এখানে দুইভাবে ভাবার সুযোগ রয়েছে। আমি এভাবে ভাবি যে ন্যায়বিচার করলে লোকজন খেপে যাবে এটা ভেবে আপনি ন্যায়বিচার করা থেকে বিরত থাকতে পারেন না।